
নীলফামারী প্রতিনিধি:
নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার তিস্তা নদী থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের দায়ে দুজনকে পাঁচ দিন করে বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। গত বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) বিকেলে উপজেলার টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের তেলীর বাজার এলাকায় এই অভিযান পরিচালনা করেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফারজানা আক্তার।
এর আগে “তিস্তা নদীতে চলছে পাথর উত্তোলনের মহোৎসব” শিরোনামে একাধিক জাতীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যমে অনুসন্ধানধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সংবাদ প্রকাশের পরই নড়েচড়ে বসে স্থানীয় প্রশাসন।”
অভিযান চলাকালে তেলীর বাজার এলাকা থেকে পাথরবোঝাই একটি ট্রলি (ট্রাক্টর) জব্দ করা হয় এবং ঘটনাস্থল থেকেই দুইজনকে হাতেনাতে আটক করা হয়। আটককৃতরা হলেন—ডিমলার দক্ষিণ খড়িবাড়ি গ্রামের মৃত আরফান আলীর ছেলে ফারুক হোসেন (২৮) এবং মৃত মোস্তাক হোসেনের ছেলে নাসির উদ্দিন (৩২)।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, তারা দীর্ঘদিন ধরে তিস্তা নদী থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করে ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফারজানা আক্তার তাদের প্রত্যেককে পাঁচ দিন করে বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেন। পরে রাতেই তাদের নীলফামারী জেলা কারাগারে পাঠানো হয়।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, সরকারি অনুমোদন ছাড়া কোনো নদী বা প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে বালু-পাথর উত্তোলন করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ধরনের অবৈধ উত্তোলনের ফলে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ পরিবর্তিত হয়, ভাঙন বৃদ্ধি পায় এবং মৎস্য সম্পদের মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হয়।
২০২৩ সালের উত্তরাঞ্চলের পরিবেশ গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, শুধুমাত্র নীলফামারীর তিস্তা নদীর ২৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মধ্যে অন্তত ১৭টি পয়েন্টে নিয়মিতভাবে অবৈধ বালু ও পাথর উত্তোলন হয়ে থাকে। বিগত তিন বছরে (২০২১-২০২৪) ডিমলা উপজেলায় ৩৫টি অভিযান পরিচালিত হলেও পর্যাপ্ত নজরদারির অভাবে অপরাধীরা পুনরায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। অন্য এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, নীলফামারী জেলার নদীভাঙনের শিকার এলাকার প্রায় ৬০% মানুষ অবৈধ খননের প্রভাব প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করেছেন।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফারজানা আক্তার বলেন, “সরকারি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও যেসব অসাধু চক্র তিস্তা নদীকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে।”
স্থানীয়দের অভিযোগ “দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রভাবশালী চক্র তিস্তার পাড় ঘেঁষে নৌকায় যান্ত্রিক মেশিন বসিয়ে ও বোমা মেশিন দিয়ে রাতের আঁধারে অবাধে পাথর উত্তোলন করছে। এর ফলে নদীভাঙন তীব্রতর হচ্ছে, কৃষিজমি ও বসতবাড়ি পড়ছে হুমকির মুখে।”
ডিমলা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ফজলে এলাহী জানান, “তিস্তা নদী রক্ষায় প্রশাসনের সঙ্গে পুলিশের সমন্বয় চলছে। অপরাধ দমনে নিয়মিত টহল ও নজরদারি আরও জোরদার করা হবে।”
নদী বিশেষজ্ঞদের মতে, তিস্তা নদী কেবল একটি প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, এটি ডিমলা উপজেলাসহ গোটা উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতি, পরিবেশ ও জীবিকার অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রশাসনের এ উদ্যোগ যেমন আইন প্রয়োগের বাস্তব দৃষ্টান্ত, তেমনি পরিবেশ সুরক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তাও স্মরণ করিয়ে দেয়।
Discussion about this post