বিভিন্ন ভুক্তভোগী প্রার্থীদের অভিযোগ, বিআরটিএ-এর মৌখিক বা লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে দালালের মাধ্যমে না গিয়ে তা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা বলেন, ঘুষ না দিলে কিংবা দালালের শরণাপন্ন না হলে লাইসেন্স পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই বললেই চলে।
একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, রাত ১২টা পর্যন্ত অফিসকক্ষে সহকারী পরিচালক দালালদের সঙ্গে বসে কাজ করছেন। সেখানে বিআরটিএ’র অন্য কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে উপস্থিত দেখা যায়নি। ওই দালালদের একজন রুহুল আমিন, যিনি পূর্বে দুর্নীতির দায়ে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ছিলেন। এতে করে সরকারি অফিসে অতিরিক্ত সময় দালালদের উপস্থিতিতে কর্মকাণ্ড পরিচালনা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছ বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। সরকারি এ দপ্তরে গ্রাহক হয়রানি নতুন কিছু নয়। তবে গাজীপুর বিআরটিএ অফিসে ঘুষ-দুর্নীতি আর গ্রাহক হয়রানি বেড়েছে কয়েকগুণ। স্বৈরাচার সরকার পতনের পরেও তাদের সময় নিয়োগপ্রাপ্তরা এখন যেন অবৈধভাবে টাকা কামানোর মহা উৎসবে নেমেছে। গত বছরের ২৪ নভেম্বর গাজীপুর বিআরটিএ অফিসে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন মো আবদুল আল মামুন। যোগদানের পরেই তিনি যোগসাজশে দুর্নীতিতে নেমে পড়েন। তবে গাজীপুর বিআরটিএর দুর্নীতি নিয়ে বেশ কিছু গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে সম্প্রতি , তবে দুর্নীতির মূলহোতা সহকারী পরিচালক আবদুল আল মামুনের বিরুদ্ধে কোন ব্যাবস্থা নেওয়া হয়নি। এছাড়াও গাজীপুর বিআরটিএ অফিসের উচ্চমান সহকারী ঘুষের ক্যাশিয়ার খ্যাত শাহ আলমের বিরুদ্ধেও কোন ব্যাবস্থা নেওয়া হয়নি।
গত সোমবার রাতে গাজীপুর বিআরটিএ অফিসে যেয়ে দেখা যায় সহকারী পরিচালক আবদুল আল মামুন এবং নতুন দায়িত্ব নেওয়া মোটরযান পরিদর্শক কেশব কুমার দাস অফিস করছেন। সূত্র জানায় পরীক্ষার বোর্ড শেষে উচ্চমান সহকারী শাহ আলমের কাছ থেকে ঘুষের টাকা বুজে নিতে এত রাতে অফিস করেন তারা। এসময় তারা অফিস ত্যাগের সময় আলোচিত দালাল ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে জেল খাটা রুহুলকেও দেখতে পাওয়া যায়। সূত্র জানায়, নতুন ইন্সপেক্টর আসার পরেই দালালদের সাথে সমঝোতায় বসেছে সহকারী পরিচালক মামুন। দালালের সাথে থাকার ভিডিও নিতে গেলে তারা দ্রুত চলে যায়।
বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে প্রথমে অনলাইনের মাধ্যমে লার্নার কার্ড করে নির্ধারিত তারিখে লিখিত,মৌখিক ও সরেজমিন পরীক্ষা দিতে হয়। পরীক্ষায় ২০ নাম্বারের লিখিত প্রশ্ন থাকে যার থেকে ১২ নাম্বার পেলেই পাশ। তবে সবথেকে বড় হয়রানি এখানেই শুরু হয়। দালালের মাধ্যমে পরীক্ষা দিতে আসলে লিখিত পরীক্ষায় কোনমতো লিখতে পারলেই পাশ দিয়ে দেওয়া হয়। আর যেসব সেবা প্রার্থীরা দালাল ছাড়া আসে তাদের ফেল করিয়ে দেওয়া হয়। মোটকথা গাজীপুর বিআরটিতে সকল সেবার একমাত্র উপায় দালাল। আর এসব দালালের মাধ্যমে গাজীপুর বিআরটির অসাধু কর্মকর্তারা হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। অনুসন্ধানে জানা যায়, গাজীপুর বিআরটিতে প্রতি সপ্তাহে ৫ টি করে ড্রাইভিং লাইসেন্স এর পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রায় ২০০ জন প্রার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। সে হিসাবে প্রতি মাসে প্রায় ৩ হাজার প্রার্থী অংশগ্রহণ করে। হিসেব মতে এসব প্রার্থীর মধ্য থেকে প্রায় আড়াই হাজার সেবা প্রার্থীর কাছ থেকে মাসে ৫০ লাখ টাকার মতো দালালের মাধ্যমে হাতিয়ে নেয় এডি ইন্সপেক্টর। এসব টাকা আদায়ের জন্য অফিসের রয়েছে নিজস্ব দালাল সিন্ডিকেট। সেবাপ্রার্থীর কাছ থেকে যত টাকাই নেওয়া হোক না কেন অফিসে ওই সেবাপ্রার্থী বাবদ দালালকে নতুন লাইসেন্স করতে ২ হাজার টাকা আর পেশাদার লাইসেন্স নবায়নে পনেরোশো টাকা ঘুষ গুনতে হয়। আর এই টাকা অফিসের প্রধান থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মাঝে নির্ধারিত হারে বণ্টন হয়। যেদিন পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, সেদিন দালালরা ঘুষের টাকা পরিশোধ করে অফিসে পরীক্ষার্থীর রোল জানিয়ে দেন। আর এরপরই পরীক্ষার্থী লিখিত, মৌখিক, প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় উপস্থিত থাকলেই পাস করেন। ঘুষের টাকা না দিয়ে পরীক্ষায় পাস করা পরীক্ষার্থীর সংখ্যা খুবই নগন্য।জহির হোসেন নামের একজন সেবাপ্রার্থী বলেন,এক দালালের মাধ্যমে ১২ হাজার টাকায় চুক্তি করেছি। নামে মাত্র পরীক্ষা দিয়েছি। দালাল বললো নতুন ইন্সপেক্টর এসেছে। তাকে নাকি ঘুষের টাকা বেশি দিতে হবে।
সচেতন মহল বলছে, সরকার পরিবর্তন হলেও স্বৈরাচার সরকারের দোসররা এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত এসব দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের আইনের মাধ্যমে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা।
অভিযোগের বিষয়ে, গাজীপুর বিআরটিএ এর সহকারী পরিচালক আবদুল আল মামুনের সরকারি নাম্বারে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএ সদর দফতরের প্রশাসনিক পরিচালক মোঃ কামরুল ইসলাম চৌধুরী জানান, “গাজীপুরের সহকারী পরিচালকের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত চলছে। খুব শীঘ্রই তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”