
নীলফামারী প্রতিনিধি:
শিক্ষার মূলভিত্তি প্রাথমিক বিদ্যালয় হলেও নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের দক্ষিণ সোনাখুলি খামার পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরকারি নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করার অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষকদের স্বেচ্ছাচারিতায় ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পাঠদান।
সরকার ২০২০ সালে প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে সময়সূচি পরিবর্তন করে দুই শিফট চালু করলেও এই বিদ্যালয়ে তার প্রতিফলন নেই। নতুন সময়সূচি অনুযায়ী সকাল ৯টায় ক্লাস শুরু হওয়ার নিয়ম থাকলেও অধিকাংশ শিক্ষক সকাল ১০টা-১১টার আগে আসেন না। বিদ্যালয়ে এসে কোনোমতে দু-একটি ক্লাস নিয়েই দুপুর ২টার মধ্যে ছুটি দিয়ে বাড়ি চলে যান। এতে পাঁচজন শিক্ষকের মধ্যে চার-পাঁচ ঘণ্টায় একটি বা দুটি বিষয়ের ক্লাস নিয়ে চলে যাওয়ায় শিশুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে এবং বেসরকারি বিদ্যালয়ের দিকে ঝুঁকছে।
মঙ্গলবার (৮ জুলাই) দুপুর ২টা ৫৫ মিনিটে দক্ষিণ সোনাখুলি খামার পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মাত্র একজন শিক্ষক উপস্থিত আছেন। একটি শ্রেণিকক্ষ ছাড়া অফিস রুমসহ অন্যান্য শ্রেণিকক্ষ বন্ধ। কেফায়েত হোসেন নামের একজন শিক্ষক পঞ্চম শ্রেণির শ্রেণিকক্ষে তৃতীয় শ্রেণির ৩ জন, চতুর্থ শ্রেণির ৫ জন এবং পঞ্চম শ্রেণির ৬ জনসহ মোট ১৪ জন শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে ক্লাস নিচ্ছেন।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এই বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ১২০ জন। এর মধ্যে শিশু শ্রেণিতে ১৭ জন, প্রথম শ্রেণিতে ২৯ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ২০ জন, তৃতীয় শ্রেণিতে ১৯ জন, চতুর্থ শ্রেণিতে ২০ জন এবং পঞ্চম শ্রেণিতে ১৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছে।
উপস্থিত না থাকা শিক্ষকদের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রধান শিক্ষক আমির উদ্দিন ও সহকারী শিক্ষক সাবিহা হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে চলে গেছেন। প্রধান শিক্ষক অফিসিয়াল কাজের কথা বললেও সহকারী শিক্ষক সাবিহা কোনো ছুটি নেননি এবং প্রধান শিক্ষক মুভমেন্ট খাতায় তার গমনের কারণ উল্লেখ করেননি। এছাড়াও সহকারী শিক্ষক নার্গিস ও রুপালিকে দুপুর ২টা ৫৫ মিনিটে বিদ্যালয়ে পাওয়া যায়নি।
বিদ্যালয়ের খেলার মাঠও অনুপযোগী। এটি ঘাস, লাউ গাছের জাংলা, গাছের গুঁড়ি এবং অন্যান্য আবর্জনায় পূর্ণ, যা খেলার মাঠের জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়।
বিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফিরছিল এক শিক্ষার্থী। কারণ জানতে চাইলে সে জানায়, শিক্ষকরা ঠিকমতো ক্লাস নেন না। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত দুটি বিষয়ে পড়ানো হয় এবং বাকি সময় খেলাধুলা করেই কেটে যায়। দুপুরেই শিক্ষকরা ছুটি দিয়ে দেন।
পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীর অভিভাবক তালেব হোসেন বলেন, “গত কিছুদিন আগে ষাণ্মাসিক পরীক্ষা শেষ হলো। ছেলেমেয়েরা নিয়মিত স্কুলে আসছে। কিন্তু ক্লাস নেওয়ার বিষয়ে শিক্ষকদের আগ্রহ নেই। তারা নিজেদের মনমতো বিদ্যালয়ে আসেন আবার ইচ্ছামতো চলে যান। এতে শিক্ষার্থীদের পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। পরীক্ষার পর লেখাপড়ায় আগ্রহী হলেও শিক্ষকদের অবহেলায় মনোযোগ হারাচ্ছে শিশুরা।”
আরেক অভিভাবক শেফালী বেগম বলেন, “প্রতিবছর সরকার নতুন বই দিচ্ছে, যেন শিশুদের লেখাপড়ায় কোনো ব্যাঘাত না ঘটে। অথচ শিক্ষকরা ঠিকমতো ক্লাস নেন না। তারা যদি গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াতেন তাহলে ফলাফল আরও ভালো হতো।”
এলাকাবাসী রফিকুল ইসলাম বলেন, “এই স্কুলে লেখাপড়ার যে হালচাল, তাতে আমাদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আমরা গরিব মানুষ, ছেলেমেয়েদের বাইরে পড়ানোর সামর্থ্য আমাদের নেই। তাই বাধ্য হয়ে এই স্কুলেই লেখাপড়া করানো হচ্ছে।”
হরি কিশোর রায় বলেন, “স্যারেরা লেখাপড়া করে শিক্ষিত হয়েছেন, আমাদের ছেলেমেয়েরা কী হবে সেটা ঈশ্বর বলতে পারবেন! এই স্কুলের লেখাপড়ার মান ভালো নয়।”
প্রধান শিক্ষক আমির উদ্দিন বলেন, “আমি তো আজকে কাজের কারণে বাইরে ছিলাম, বিদ্যালয়ে ছিলাম না। তাই কিছু বলতে পারব না। আর এভাবে তো ক্লাস নেওয়া হয় না। কালকে গিয়ে শুনব।”
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার বীরেন্দ্র নাথ রায় বলেন, “বিষয়টি প্রধান শিক্ষকের নিকট শুনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারণ তিনি তো এটি করতে পারেন না।”
এ ব্যাপারে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কুমারেশ কুমার গাছি জানান, “বিষয়টি আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। প্রয়োজনীয় তদন্ত শেষে দোষী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
সুশীল সমাজের মতে, সরকারি বিদ্যালয়ের এমন দুরবস্থা দ্রুত সমাধান করা প্রয়োজন, অন্যথায় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে পড়বে।
Discussion about this post